মদীয় ফ্যান্টাসি: তিলেক ডিকোডিং
মদীয় ফ্যান্টাসি: তিলেক ডিকোডিং
রাহেবুলদার “মদীয় ফ্যান্টাসি”পড়তে পড়তে কোথায় যেন একটা পাঠ প্রতিক্রিয়া দেবার ফ্যান্টাসি
চলে এলো। যদিও এত উচ্চমানের লেখায় পাঠ প্রতিক্রিয়া দেবার সাহস বা সামর্থ্য কোনোটাই
নেই এই অধম পাঠকের। তবু দুস্পর্ধা দেখাবার সাহস করেই ফেললাম। আমি খুব সামান্য একজন
পাঠক। পাঠক বললে অবশ্য ভুল হবে নিজেকে কবিতা বিলাসি বলাই ভালো। সবার
লেখা ভালো লাগেনা, সবার লেখা—সবসময় পড়ে ওঠার
সময় হয়ে ওঠে না বলেই হয়তো অনেক মুক্তসম লেখা আমার পরিধির বাইরে থেকে যায়। আগেই
বলেছি আমি নিয়মিত পাঠক নই। কিন্তু আমার বন্ধু লিস্টের রাহেবুলদা কিংবা সঙ্গীতা
মাইতির লেখাগুলো চোখে পড়লেই না পড়ে থাকতে পারিনা। এদের লেখাগুলো আমায় প্রচণ্ডভাবে টানে। যদিও লিখনশৈলী দু'জনের দুই
প্রকৃতির। রাহেবুলদার শব্দ কিংবা কবিতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাংলা সাহিত্যের
বাঁক যে পরিবর্তন হচ্ছে তার পূর্বাভাস। কবিতাগুলো পড়তে পড়তে শব্দগুলো ভাঙতে ভাঙতে
হারিয়ে যেতে হয় কবিতার মধ্যে। তবু দুর্ভেদ্য। রাহেবুলদার কবিতা ভেদ করে ওঠার
সামর্থ্য আমার মতো সাধারণ পাঠকের সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে লেখার মধ্যে আছে এমন
এক মাদকতা যা সহজেই একজন পাঠককে গ্রাস করে। আর পাঁচজন কবিতার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
চলার পথটাও তাই হয়তো আলাদা। আমি যতদূর রাহেবুলদাকে বুঝেছি সেখানে কোনো কবিতা
গোষ্ঠীতন্ত্র নেই, নেই কোনো মিথ্যে
আত্মবঞ্চনা। এখানেই কবি স্বতন্ত্র। উত্তর আকাশে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা সেই নক্ষত্র
যাকে অস্বীকার করার জায়গা নেই। আমার বিশ্বাস একদিন এই নক্ষত্রও একটা আলাদা নাম
পাবে। কবি কবিতার জন্য কবিতা লেখেন না। যা লেখেন তাই কবিতা হয়ে ওঠে। ভাষার মধ্যে
মেকআপ কম। কবিতা অক্ষরে দরদের থেকে সত্যতা অনেক বেশি। তবে অবশ্যই সাংকেতিকতা। অনেকটা
চর্যাপদের মতোই আলো-আঁধারি বলেই হয়তো পাঠকের কাছে পুরোটা ধরা হয়ে ওঠে না। অনেকটাই
অধরা থেকে যায়।
তাঁর "মদীয় ফ্যান্টাসি"র প্রথম কবিতা
"মরাভরাচান্দ" কবিতার প্রথম লাইন
"কথা ছিল ভাঙার। কীরূপ
কথা, কাহার লগে, তাহা ছিল অনুল্লেখ"
পড়েই বোঝা যায়
কবির কলম থামবার নয়। যেমন ভাষা, তেমন শৈলীও
স্বতন্ত্র। এখানেই কবিকে আলাদাভাবে হাজার ভিড়ের মাঝেও চিনিয়ে দেয়।
বইটা হাতে নিয়ে
একঝলক কবিতার নামগুলো দেখলেই বুঝতে পারা যায় কবির মতোই স্বতন্ত্র তাঁর কবিতার
নামগুলো—"রিভিজিটেড: পানি", "অথবা কচুকাটা রাই", "N কোড",
"বগা ও শর্টসার্কিট",
"বাউলা", "হে", "পানিপট্টি", "লুকোছুপো লিওনি", "গুঁড়ো কবিতা....", "ডটে কম" প্রভৃতি। বিষয়-আঙ্গিকও একক। বোঝাই
যায় কলম যথেষ্ট শক্তিশালী। এ যেন "অচলায়তন" এর পঞ্চক বা শুভদ্র।
তাঁর কবিতায় এসেছে
যেমন আত্ম বিশ্লেষণ, আবার বর্তমান
অস্থিরতা সবমিলিয়ে একটা যুগযন্ত্রণা। তাই তিনিই বলতে পারেন "একটা ঘুমের
কিন্তু ব্যাপক চাহিদা দ্যাশ জুড়িয়া।"(রিভিজেটেড: পানি), আবার "অথবা কচুকাটা রাই"-এ
"ভেন্টিলেটরে পুঁজ সংরক্ষণ হতে হতেই পুঁজিপতি আমি।"
তাঁর এই কাব্যের
শেষ কবিতা "কুহেলি"-র একটা লাইন "ফুটেজ খায় কানের দেয়াল...."
সম্পর্কে আর কিছুই বলার থাকে না। অন্যদিকে ঈশ্বর অস্তিত্ব নিয়ে তিনি বরাবরই
সন্দিহান "মানুষ নির্মিত সর্ব উৎকৃষ্ট মিথ: ঈশ্বর"(ঈশ্বরের পাঠ)। কখনো
প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন পাঠকের কাছে কাহার লগে,
তা
অবশ্য অনুল্লেখ—"ঘাস কাটতে ব্যস্ত ঘোড়া কী মনে করে তোমার গুঁড়ো ঘুমে?"(গুঁড়ো কবিতা), কখনো অল্পতেই খুশি থাকার প্রয়াস "মাইরি এতটুকুন লয়েই
আমি তবু খুশ।"
ভালো লেগেছে তাঁর "আখা" কবিতায়
"কতগুলি
মরমিয়া আগুন পুড়ছিল একা একা।
দুই বেড়াল আর
আমিতে মিলে আখার পাড়ে বসে।"
অবশ্য কতটুকু পোড়ার
পর নিজেকে বিদগ্ধ বলা যায় আমি জানিনা।
তাঁর
"পানিপট্টি” কবিতায় "আম্মা আব্বা আমার পাশে শুয়ে— আমার কবরের পাশে
শোবে তেমন?" সত্যিই অসাধারণ
লাইন। যদিও তিনি "এ আবদার আদায় করেনি,
এ
মতন ভাবছুলুম।"
আবার বর্তমান
অস্থিরতা ধরা পড়েছে তার কবিতায় খুব সুন্দরভাবে "কেউ কোনোদিন হোঁচট খায় না
দড়িতে যা সে প্রত্যহ খায় সাধের জনতন্ত্রের সদর দরজায়"(গোরুগোঁসাইজি)। "আগুন
পুড়ছে" সত্যিই আগুন পুড়ছে। "সাদাসুন্দর কোয়ি আগুন"(সম্বাদ)।
"ইঁদুর দৌড় দিতে দিতে ইঁদুরকে ভুলে যায় কি
একদিন?"(পার্থিব) জানা
নেই। হয়তো বা যায়। "কোনোদিন স্টাডি করে দেখ মাংসাশী পিঁপড়ে..../বা মাংসাশী
মানুষ....." (বাউলা)। "তোমার কর্পোরেট করমর্দন আজ আমায় বাউলা
বানায়...." (বাউলা) এরপর আর কি বলার থাকে? এক কথায় সত্যিই "মদীয়
ফ্যান্টাসি"।
খারাপ লাগার কোনো
জায়গা নেই। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ এই "মদীয় ফ্যান্টাসি"। আর প্রথম
কাব্যগ্রন্থই প্রথম বলে বাউন্ডারি। তবে সেটা চার না ছয় আগামী সময়ই বলবে। এ তো শুধু
ভালোলাগার কথাই বললাম।
এবার আসি কিছু
মন্দলাগার কথায়, ভাষা-বিষয় অনেক
বেশি গভীর, উচ্চমানের কিন্তু প্রশ্ন
থেকেই যায় সাধারণ পাঠক কতটা নিতে পারবে!!! যদিও কবি কখনো পাঠকের কথা ভেবে লেখেন
না। লেখেন নিজের কথা ভেবে। আর পাঠকের কথা ভেবে লিখলে সেটা আর কবিতা হয়ে ওঠে না। অনেকটা
তোষণ হয়ে যায়। এটা আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু তবু পাঠক বলে কিছুর অস্তিত্ব থেকেই
যায়। যাকে অস্বীকার করার সাধ্য আমাদের কারোর নেই। কবিতার বিষয় ছুঁতে হয় অনেক কষ্ট
করে, তাই আমার মতো একজন সাধারণ
পাঠকের কাছে কবিতাগুলো কিছুটা আলো-আঁধারি মনে হয়। সবশেষে এটাই বলবো কবির
প্রত্যেকটা কবিতার মশাল অক্ষর একদিন আলোকিত করবে এই বাংলা সাহিত্যকে। আর আশা রাখবো
এভাবেই কবি এগিয়ে যাবেন আপন খেয়ালে এক ভিন্ন পথের দিশারী হয়ে। জানি সিসিফাস (কবির
ছদ্মনাম) একদিন সেই পাথরটা উপরে তুলবেই। আর সেদিন হয়তো বেশি দেরি নেই। কবির সাফল্য
কামনা করি।
আর সেই সঙ্গে
বাংলা সাহিত্যের অনুরাগীদের জানাই কবির "মদীয় ফ্যান্টাসি" হাতে তুলে
নিয়ে দেখুন অনেক কিছু শেখার। নতুন স্বাদের সদ্য আবিষ্কৃত খনি। ভালোবেসে পড়ুন। আশা
করি আপনাদের ভালো লাগবে।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
কাব্য- মদীয় ফ্যান্টাসি
কবি- রাহেবুল
প্রচ্ছদ- সোনিয়াকামোজ
কবিতা সংখ্যা- ৫২
প্রকাশক- সৃষ্টিসুখ (কলকাতা)
প্রাপ্তিস্থান- ৩০এ সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট, কলকাতা-৯ (এবং সৃষ্টিসুখের ওয়েবসাইট)
যোগাযোগ- +91 90512 00437
👌👌👌👌👌
ReplyDelete❤❤
Delete